গাছ যখন লাগাবেন- তখন পাওলোনিয়া গাছ নয় কেন?

গাছ যখন লাগাবেন- তখন পাওলোনিয়া গাছ নয় কেন?

শোভাবর্ধনকারী জীবনবৃক্ষ পাওলোনিয়া

পৃথিবীজুড়ে সাড়া জাগানো এক বৃক্ষের নাম পাওলোনিয়া। কাঠ উৎপাদনকারী বৃক্ষের মধ্যে পাওলোনিয়া অন্যতম। এটি ল্যামিয়েলিস বর্গের পাওলোনিয়াসি
পরিবারভুক্ত বহু বর্ষজীবী উদ্ভিদ। উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় এ গাছ ভালো জন্মে। গাছের পাতা বড় হওয়ায় এটি শোভাবর্ধনকারী বৃক্ষ হিসেবেও পরিচিত। এ গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায়। চারা লাগানোর প্রথম বছরেই ১৮ থেকে ২০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। আর ছয় থেকে আট বছরে ৬০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। আট বছর বয়সী গাছে পরিপক্কতা আসে। এ গাছের পাতা সবুজ, প্রচুর তন্তুযুক্ত, আকারে বড়, দেখতে অনেকটা হৃৎপিণ্ডাকার বা ডিম্বাকার। আদি বাসস্থান চীনে। নেদারল্যান্ডসের রানী আনা পৌলোনার সম্মানে এ গাছের নামকরণ করা হয়েছে। তাই এটি প্রিন্সেস ফিনিক্স বা রয়েল এম্প্রেস বৃক্ষ হিসেবে পরিচিত। এটিকে রাজকন্যা গাছও বলা হয়। জাপানে এ গাছকে 'কিরি' আর চীনে 'ড্রাগন ট্রি' বলা হয়। 'কিরি' শব্দের অর্থ জীবন। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে উন্নতমানের কাঠের জন্য এর জনপ্রিয়তা খুব বেশি।

পাওলোনিয়া গাছের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য:

দ্রুত বর্ধনশীল; আট বছর বয়সী একটি গাছ থেকে গড়ে ১০ থেকে ১২ সিএফটি কাঠ পাওয়া যায়; গরু-ছাগলে এই গাছ খায় না; কাঠ শক্ত, দীর্ঘস্থায়ী ও গিঁটমুক্ত। কাঠের রং হলুদাভ থেকে হালকা লাল হয়ে থাকে; কাঠের ফাইবার খুব সোজা, মসৃণ ও হালকা; এ গাছ ট্যানিন পদার্থ সংরক্ষণ করে যা গ্রাইন্ডার বিটল প্রতিরোধী; এ গাছের ফুল থেকে উন্নতমানের মধু পাওয়া যায়; এ গাছ পরিবেশবান্ধব। সাধারণ গাছের চেয়ে এই গাছ তিন গুণ বেশি অক্সিজেন দেয়; এ গাছের কাঠ উচ্চ তাপ সহনশীল, তাই সহজে আগুনে পোড়ে না; পাতা বড় হওয়ায় প্রচুর কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে; মাটির ক্ষয়রোধ করে এবং লবণাক্ততা কমায়।

চার থেকে পাঁচ বছরের মধ্যেই পাওলোনিয়া গাছে ফুল ও ফল আসে। ফুল সুগন্ধযুক্ত, আকারে বড়, রং বেগুনি-নীলাভ (কখনও কখনও সাদা)। ফুল ফুটলে প্রায় চার সপ্তাহ পর্যন্ত গাছে থাকে। পাওলোনিয়া বৃক্ষরাজির কাছাকাছি মৌবাক্স স্থাপন করে মধু সংগ্রহ সম্ভব। বীজ খুব ছোট। বীজ থেকে চারা তৈরিতে অনেক সময় লাগে, খুব কম সংখ্যক অঙ্কুরোদ্গম হয় এবং বীজের চারা নানা ধরনের জীবাণু দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। টিস্যু কালচার বা রুট কাটিং পদ্ধতিতে অল্প সময়ে অধিক চারা তৈরি করা যায় এবং চারা দ্রুত বেড়ে ওঠে। সারাবছর এ গাছের চারা উৎপাদন করা যায়। রোপণের জন্য এপ্রিল থেকে জুলাই মাস উত্তম। প্রতি বিঘা জমিতে ১৫০টি চারা লাগানো যায়। পাতা ও শিকড় দেখে ভালো চারা চিনে নিতে হবে। পাতায় কোনো দাগ থাকবে না। পাতায় কোনো দাগ থাকলে বুঝতে হবে এটি অসুস্থ চারা। দিনের বেশিরভাগ সময় রোদ থাকে, এমন জায়গায় চারা লাগাতে হবে।

চারাগাছে ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে হবে। গাছে অতিরিক্ত পানি দিলে, ঘন করে গাছ লাগালে, হঠাৎ তাপমাত্রার পরিবর্তন ঘটলে অ্যাফিডস, স্কেল পোকা ও ব্ল্যাক লেগ কীটপতঙ্গের আক্রমণ ঘটতে পারে। এতে চারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এমনকি মারাও যায়। এজন্য রোপণের আগে পটাশিয়াম ম্যাঙ্গানিজ দ্রবণ দিয়ে মাটি জীবাণুমুক্ত করতে হবে। চারা রোপণের পর অতিরিক্ত পানি দেওয়া যাবে না। পরিমিত পরিমাণে পানি দিতে হবে। টানা খরা থাকলে গোড়ায় নিয়মিত পানি দেওয়া বাধ্যতামূলক। আগাছা হলে ছাঁটাই করতে হবে, কারণ আগাছা চারার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

সাধারণত দুই থেকে তিন বছর বয়স পর্যন্ত চারার পরিচর্যা করতে হয়। গাছের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় জৈবসার প্রয়োগ করতে হবে। চারার গোড়ায় পানি
জমতে দেওয়া যাবে না। দুই বছর পর্যন্ত গাছের পার্শ্বশাখা কেটে দিতে হবে। তৃতীয় বছরে পার্শ্বশাখা কাটা বন্ধ করতে হবে।

গাছ থেকে কাঠ পেতে হলে সাত থেকে আট বছর অপেক্ষা করতে হবে। ওই সময়ে কাঠে পরিপক্কতা আসে। আর যদি জৈব জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করতে হয়, তাহলে তিন থেকে চার বছর পর কেটে প্রক্রিয়াজাতকরণ করতে হবে। দামি কাঠের গাছ সাধারণত পরিপক্ক হতে ২০ থেকে ৩০ বছর সময় লাগে। কোনো কোনো গাছের ক্ষেত্রে আরও বেশি বছর সময় লাগে। এসব বিবেচনায় পাওলোনিয়া গাছ অধিক লাভজনক।

গ্রামীণ বা শহরের বাস্তুতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গাছ এটি। একটু উঁচু জমি হলেই এ গাছ লাগানো যায়। ব্যক্তি উদ্যোগ কিংবা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এ গাছ লাগিয়ে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া সম্ভব। কারও বেশি পরিমাণে গাছ লাগানোর জায়গা যদি না থাকে, তাহলে রোদ থাকে এমন সামান্য জায়গাতেও কয়েকটি গাছ লাগিয়ে পরিবারের অর্থকষ্ট দূর করা সম্ভব। অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, জার্মানি, স্পেন, পর্তুগাল, ভিয়েতনামসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পাওলোনিয়া গাছ দ্বারা বনায়ন করা হয়েছে। আমাদের দেশেও অর্থনৈতিকভাবে পাওলোনিয়ার বনায়ন সম্ভব।

Back to blog